মধু বৃন্দাবনে বনে পর্ব ১

(চৌরাশি ক্রোশ ব্রজ মণ্ডন পরিক্রমা) – পর্ব ১

এবারের জুন মাসের প্রথম সপ্তাহের একটা সকাল। সবে মাত্র চায়ে একটা চুমুক দিয়েছি। বেজে উঠল ফোনটা। বহরমপুর থেকে আমাদের গুরুভাই ডাঃ রবীন চ্যাটার্জী ফোনের ওপাড়ে। ডাক্তারবাবু বললেন, চন্দন,  পূজোর পরে দ্বাদশীর দিন ভাবছি দিল্লী আগ্রা হয়ে বৃন্দাবন বেড়াতে যাব। তুমি একটা বেড়ানোর প্ল্যান করে দিও। একটু ভাবলাম। ডাক্তারবাবুকে বললাম একটু পড়ে আপনাকে ফোন করছি। ঠাকুরঘর এ আমার দিদা সদ্য তখন ঠাকুরকে জাগরণ করিয়ে বাল্যভোগ নিবেদন করছেন। রাধামাধব এর মুখের দিকে চাইতেই যেন কোন এক নারীকন্ঠ যেন অন্তরে বলে উঠল ” ওরে ডুব দিবি না রাধাকুন্ডে? আয়, আয়। ”  বুঝে গেলাম সে নির্দেশ। দিদাকে বললাম যাবে মা বৃন্দাবন?  পূজোর পরে?  চৌরাশি ক্রোশ পরিক্রমা আবার করবে? দিদা সায় দিল। রাই পাস থেকে বলে উঠল ” বাবা আমিও বৃন্দাবন যাব।” যাবিই তো মা, তোরই তো জায়গা। তোকে নিয়ে সবাই যাব আমরা। সাথে সাথে ফোন করলাম বৃন্দাবনে আমাদের তীর্থগুরু হরিওম শর্মাজী কে। শর্মাজী ও বললেন ” রাধারানীর কৃপা হয়েছে চন্দন, চলে আয়। খুব ভাল হবে। দামোদর মাস, নিয়মসেবার সময়।২১ শে অক্টোবর রাধাকুন্ডে স্নান যোগ ও আছে। চলে আয়।” সিদ্ধান্ত পাকা হয়ে গেল। একে একে ফোন করে নিলাম সাগরদিঘীতে চণ্ডীদাকে, বাবুয়াদা কে, জঙ্গীপুরে অশোকদা, ভরতকে, ভদ্রেশ্বরে সৈকত, মানকুন্ডুর সুবীরদাকে,বিশাখাপত্তনমে অর্ককে। সবাই এককথায় রাজী। মাত্র আধঘণ্টার মধ্যে ঘটে গেল গোটা ব্যাপারটা। এবার ডাক্তারবাবুকে ফোন করে প্রস্তাবটা দিলাম যে আপনারা আমাদের দুদিন আগে বেড়িয়ে পড়ে দিল্লী – আগ্রা ঘুরে নিয়ে আমাদের সাথে যোগ দিন টুন্ডলা স্টেশনে। সেখান থেকে চলুন বৃন্দাবন।  ৮৪ ক্রোশ পরিক্রমায়। উনিও রাজী হয়ে গেলেন।  আমাদের যাত্রার দিন স্থির হল ১১ ই অক্টোবর, ত্রয়োদশীর দিন। সেই মত ১২০ দিন আগে ১৩ই জুন টিকিট কাটতে সবাই মিলে বহরমপুর এর রির্জাভেশন কাউন্টারে লাইন দিলাম। পূজোর বুকিং। মারাত্মক ভীড়। আমি, অশোকদা, সূরজ, ভরত, বাবু সবাই মিলে হইহই করে টিকিট কেটেও ফেললাম। কালকা বা পূর্বাতে অতগুলো টিকিট পেলাম না। অগত্যা নিতে হল শিয়ালদা- আজমীঢ় সুপারফাস্টে। তাই সই। যাওয়া তো হচ্ছে। আবার নির্দ্ধারিত দিনে রির্টান টিকিট ও কেটে নিলাম কালকা মেলে। এবার কাউন্ট ডাউন। দিন গোনার প্রতীক্ষা। বৃন্দাবন। মধুময় বৃন্দাবন। রাধারানীর কৃপা না হলে হাজার চেষ্টা করেও কেউ এই ভূমিতে পা রাখতে পারবেন না, একথা বলতেন আমার বাবা মানে শ্রীগুরুদেব।  তাই অত্যন্ত নিষ্ঠা দিয়ে প্রতিদিন ভোরে প্রার্থনা করতাম রাধারানী, কাত্যায়নী,  বাবাজী মহারাজ ও বাবার কাছে, যেন আমাদের বৃন্দাবন যাত্রা নিরাপদ ও নির্বিঘ্ন হয়। বাবাই শিখিয়ে ছিলেন এই প্রথাটিকে যে, তীর্থে যাত্রার আগে প্রার্থনা করে তীর্থদেবতার কৃপা চাইতে হয়, তাহলে যাত্রা নির্বিঘ্ন ও আনন্দময় হয়। গুরুবাক্য অমোঘ, বেদবাক্য।তা ঘটবেই। এ বিশ্বাস আমার অন্তরের। প্রমান ও পেয়েছি বারে বারে। এবারো পেলাম। যাত্রার কদিন আগে খবর এল আমাদের যাবার ট্রেন আজমীঢ় এক্সঃ এর রুট ডাইভারশান হয়ে গেছে ২৬ শে সেপ্টেম্বর থেকে ১৯ শে অক্টোবর অবধি। আমাদের নামার কথা টুন্ডলা তে। কিন্তু ট্রেন কানপুর থেকে ডাইভারশান হয়ে ইটাওয়া হয়ে বেড়িয়ে জয়পুরে চলে যাবে, টুন্ডলা ঢুকবে না। প্রমাদ গুনতে লাগলাম সবাই। কি হবে তাহলে? সবাই বলল কানপুর অবধি তো যাই, তারপর বাবা যা ব্যবস্থা করবেন তাই হবে। হরিওমজী বললেন কানপুর অবধি তো চলে আয়, সেরকম হলে আমি বৃন্দাবন থেকে একটা বাস কানপুরে পাঠিয়ে দেব তোদের আনার জন্য। যাই হোক, প্রতি নিয়ত বাবাকে ডেকে যাচ্ছি” কৃপা করুন গুরুদেব যেন বিঘ্ন কেটে যায়, যাতে নির্বিঘ্নে বৃন্দাবন পৌঁছতে পারি। ”  পূজোর ঠিক চার দিন আগে দুপুরে  ১টার সময় হঠাৎ বৃন্দাবন থেকে হরিওমজীর ফোন- ” চন্দন, তোদের চিন্তা কেটে গেল। তোদের ট্রেন ডাইভারশান হয়ে টুন্ডলা না গেলেও আগ্রা ক্যান্টনমেন্ট হয়ে যাবে। তাহলেভ। তো কোন সমস্যা হবে না। তোরা আগ্রা ক্যান্টনমেন্ট এ নেমে যাবি, আমি তোদের আনার জন্য একটা বাস রির্জাভ করে বৃন্দাবন থেকে আগ্রা স্টেশন পাঠিয়ে দেব। আনন্দে আমি তখন লাফ মেরে উঠেছি। ফোন করে জানালাম বাবুকে, সূরজকে। একেই বলে গুরুকৃপা। কত করুনাময় আমার গুরুদেব। যখন দেহে ছিলেন তখন যেমন করে কৃপা করতেন, অপ্রকট হবার পরও ঠিক সে ভাবেই কৃপা করে যাচ্ছেন।  আনন্দে তখন আমি কেঁদে ফেলেছি। বুঝেগেলাম, চৌরাশি ক্রোশ ব্রজমন্ডল পরিক্রমা আমাদের আনন্দময় হতে চলেছে।

পূজো পাড় হল। একটা ঘোরের মধ্যে কাটছে আমার। বৃন্দাবন যাচ্ছি। এর আগেও তিনবার গেছি। ২০০৪ সালে বাবার সাথে চৌরাশি ক্রোশ ব্রজ পরিক্রমাও করেছি। এবার যেন একটা অবর্ণনীয় অনুভূতি হচ্ছে।লিখে বোঝাতে পারব না। ১০ ই অক্টোবর রাত আড়াইটে অবধি লাগেজ গুছালাম। রাত ৩ টের সময় শুলাম আবার রাত সাড়ে ৩ টেয় ঘুম থেকে উঠে গেলাম।স্নান করে ঠাকুর ঘরে ঢুকলাম।কারন একাদশীর দিন থেকে নিয়মসেবা শুরু হয়ে গেছে। সূর্য্য ওঠার আগে মঙ্গলারতি শেষ করতে হবে। একমাস চলবে নিয়মসেবা।  ” রাই জাগো শ্যাম জাগো জাগো শুক শারী বলে….. ” রাধামাধব এর জাগরন, মঙ্গলারতি দিয়ে সকাল হয়ে গেল। সকাল ৯ টায় সবাই মিলে বেড়িয়ে পড়লাম বহরমপুর স্টেশন এর দিকে। ১০:১৫ র ট্রেন এ যাত্রা শিয়ালদার উদ্দেশ্যে। অশোকদা, রীতাবৌদি, ভরত,রাজলক্ষ্মী, ভরতের দুই ছেলে ধরনী ও ধ্যানেস, আমি,  দিদা, তিথি, রাই,  মামন ও বাবু ( আমার শ্বশুর মশাই ও শ্বাশুড়ি) রওনা দিলাম একসাথে। শিয়ালদাতে যোগ দেবে চণ্ডীদার পরিবার, বাবুয়াদার পরিবার, সৈকতের পরিবার। অর্ক ও সুবর্না আজ সকালেই তুফান এক্সঃ ধরে রওনা হয়ে গেছে।ওরা  আমাদের সাথে যোগ দেবে কাল মোঘলসরাইতে। আর ডাক্তারবাবু রা চারজন আগেই দিল্লী চলে গেছেন। ওরা কাল রাত্রে আগ্রা ক্যান্ট স্টেশনে আমাদের সাথে যোগ দেবে। টিমে সব শুদ্ধু ২৮ জন। বিকেল ৩ টেয় শিয়ালদা পৌঁছে গেলাম। স্টেশনে দেখা করতে এল আমার স্কুল জীবনের বন্ধু সুবু মানে চুঁচুড়ার সুব্রত। কিছুক্ষন নস্টালজিয়াতে ভেসে যাওয়া। রাত ১১ টায় চেপে বসলাম আমাদের আজমীঢ় এক্সঃ ট্রেনে। ট্রেন ছাড়ল।  রাত ১২টায় বর্ধমান পাড় হয়ে দুর্বার গতি বাড়াল ট্রেন। পদ্মনাভের কৃপায় দু চোখ জুড়ে আমার তন্দ্রা নেমেছে।

( চলবে)

এটি ইংরেজিতে পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *