লেখক : উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী
শিবের সঙ্গে যখন পার্বতীর বিবাহ হইল, তখন পার্বতী কৈলাস পর্বতে আসিয়া ঘরকন্না করিতে লাগিলেন। শিব খেয়ালশূন্য লোক, তাহাতে আবার ভূতের দল নিয়া থাকেন- মেয়েরা বাড়িতে থাকিলে কেমন করিয়া চলাফেরা করিতে হয়, সেদিকে তাহার নজর একটু কম। যখন তিনি তাহার ভূতদের নিয়া বাড়ির ভিতর আসিয়া উপস্থিত হন, পার্বতী আর তার সখীদের তাহাতে বড় অসুবিধা হয়! দরোয়ান নন্দী তাহাকে মানা করিলেও তিনি তাহা শোনেন না, তাহাকে ধমকাইয়া ঠিক করিয়া দেন।
পার্বতীর সখী জয়া আর বিজয়া ক্রমাগতই বলেন, “ইহারা সকলেই শিবের লোক, তাঁহার ধমকে ভয় পায়। আমাদের নিজের একটি ভালো লোক হইলে বেশ হইত।” এ কথায় পার্বতী কাদা দিয়া যারপরনাই সুন্দর একটা খোকা তৈরি করিলেন, তাহার নাম হইল গনেশ। সেই খোকাটিকে তিনি সুন্দর পোশাক আর গহনা পরাইয়া দরোয়ান সাজাইয়া লাঠি হাতে দিয়া দরজায় বসাইয়া দিলেন। গণেশ জিজ্ঞাসা করিলেন, “এখানে বসে আমি কি করব? পার্বতী বলিলেন, “বাবা, তুমি এখানে দরোয়ান হবে, কাউকে ঢুকতে দিবে না।”
এই বলিয়া গণেশের মুখে বার বার চুমো খাইয়া পার্বতী স্নান করিতে গেলেন, আর তাহার খানিক পরেই শিব তাহার ভূতপ্রেত লইয়া আসিয়া উপস্থিত হইলেন। কিন্তু গণেশ দরজা ছাড়িবার লোক নহেন। তিনি বলিলেন, “কোথা যাচ্ছ? থামো, মা স্নান করছেন।” বলিয়াই তিনি লাঠি তুলিলেন। শিব আশ্তর্য হইয়া বলিলেন, “আরে, আমি শিব।” গণেশ বলিলেন, “শিব আবার কে! তুমি কেন যাবে?” শিব বলিলেন, “এ তো দেখছি ভারি রোখা। আরে আমি পার্বতীর স্বামী।” বলিয়া তিনি যেই টুকিতে যাইবেন, অমনি গণেশ ধাঁই করিয়া তার পিঠে লাঠি মারিয়া বসিয়াছেন।
তখন তো বড়ই’ বিষম কাণ্ড উপস্থিত হইল। শিবের হুকুমে তাহার ভূতেরা আসিয়া গণেশকে শাসাইতে লাগিল। গণেশ তাহাদের বিকট চেহারা দেখিয়া একটুও ভয় পাইলেন না। তিনি বলিলেন, “বাঃ! মুখের ছিরি দেখ। যা বেটারা এখান থেকে ।”
ভূতেরা বড়ই মুশকিলে পড়িল | তাহাদের হাসিও পাইয়াছে। রাগ হইয়াছে, আবার ভয়ও হইয়াছে। তাহারা এক-একবার শিবের কাছে ফিরিয়া ষায়। আবার তাঁহার তাড়া খাইয়া গণেশের কাছে আসিয়া দাঁত খিঁচায়। গণেশ লাঠি-লইয়া তাড়া করিলে আবার শিবের কাছে ছুটিয়া যায়।
যাহা হউক, শেষে তাহারা শিবের কথায় খুব সাহস পাইয়া গণেশের সঙ্গে যুদ্ধ আরম্ভ করিল। নন্দী আর তৃঙ্গী দুজনে আসিয়া তাহার দুই পা ধরিয়া দিল টান, আর গণেশ ঠাসঠাস করিয়া তাহাদের দুজনকেই মারিলেন দুই থাপ্পড় । তারপর দরজার হুড়কা লইয়া ভূতের দলকে তিনি এমনি ঠ্যাঙান ঠেঙ্গাইলেন যে কি বলিব!
এদিকে নারদ মুনি গিয়া দেবতাদিগকে এই যুদ্ধের সংবাদ দিয়াছেন, দেবতারাও সকলে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছেন। ব্রহ্মা, বিষ্ণু, ইন্দ্র প্রভৃতি দেবতা, মুনি-ঋষি, অপ্সরা, কেহই আসিতে বাকি নাই।
শিব তখন ব্রন্মাকে বলিলেন যে, “দেখ তো ওই ছেলেটিকে বলিয়া কহিয়া শান্ত করিতে পার কিনা ।”
শিবের কথায় ব্রল্মা মুনি-ঋষি দিগকে লইয়া গণেশকে শান্ত করিতে গেলেন। গণেশ তাহাকে দেখিয়া ভাবিলেন, বুঝি ভূত আসিয়াছে, কাজেই বুঝিতেই পার- ব্রন্মার মুখে যত দাড়ি ছিল, সব তিনি ছিড়িয়া ফেলিলেন, ব্রহ্মা যত চ্যাঁচান, “দোহাই বাবা, আমাকে মারিও না, আমি যুদ্ধ করিতে আসি নাই,” গণেশ ততই আরো বেশি করিয়া তাহার দাড়ি ছিড়েন। তাহাতেও সন্তুষ্ট না হইয়া শেষে দরজার হুড়কা লইয়া তাহাকে তাড়া করিলেন। তখন আর কাহারও সেখানে থাকিতে ভরসা হইল না, সকলে উধ্বশ্বাসে শিবের নিকট গিয়া উপস্থিত হইল। তারপর সকল দেবতা আর ভূত মিলিয়া গণেশের সঙ্গে যে যুদ্ধ. করিল, সে বড়ই ভীষণ।
পার্বতী দেখিলেন যে গণেশের বড়ই বিপদ উপস্থিত, এখন আর শুধু লাঠি হুড়কা লইয়া যুদ্ধ করিলে চলিবে না, তাই তিনি দুইটা ভয়ংকর শক্তি তৈরি করিয়া গণেশকে দিলেন।
তাহার একটার মুখ এমনি বিকট যে, সে হাঁ করিলে পাহাড় পর্বত গিলিয়া ফেলিতে পারে। আর-একটা বিজলীর মতো ঝলমল করে, আর তাহার যে কত হাজার হাত তাহা গুনিয়া শেষ করা যায় না। সেই দুই শক্তি দেবতাদের সকল অস্ত্র গিলিয়া ফেলিতে লাগিল, কাজেই গণেশের গদার সামনে তাহাদের কেহই টিকিতে পারিলেন না। দেবতা আর ভূত সকলকেই পলাইয়া প্রাণ বাচাইতে হইল। তাঁহারা কত যুদ্ধ করিয়াছেন, আরো কত যুদ্ধ দেখিয়াছেন, কিন্তু এমন বিপদে আর কখনো পড়েন নাই। তখন শিব আর বিষ্ণু পরামর্শ করিলেন যে, এই ছেলেটাকে ছল করিয়া মারিতে না পারিলে আর উপায় নাই। বিষ্ণু, শিবকে বলিলেন, “আমি সম্মুখ হইতে যুদ্ধ করিয়া ইহাকে ভুলাইয়া রাখিব। সেই সময় তুমি পিছন হইতে ইহার প্রাণ বধ করিবে 1”
এই বলিয়া বিষ্ণু মায়ার বলে গণেশের শক্তি দুটিকে অবশ করিয়া দিলেন। কিন্তু তাহাতে গনেশ ভয় না পাইয়া এমনি গদা ছুঁড়িয়া মারিলেন যে, তাহা সামলাইতে বিষ্ণু অস্থির ।
তাহা দেখিয়া শিব মহারাগে ত্রিশূল হাতে লইলেন । কিন্তু গনেশের গদার ভয়ে তাহা তাঁহারা হাত হইতে পড়িয়া গেল, তাহাতে তিনি পিনাক ( শিবের ধনুক ) হাতের নিলেন, তাহাও গনেশের গদার ঘায়ে পড়িয়া গেল, আর সেই অবসরে গণেশ তাহার পাঁচখানি হাত কাটিয়া ফেলিলেন। তারপর গণেশ আবার বিষ্ণুকে গদা ছুঁড়িয়া মারিলেন, কিন্তু বিষ্ণুর চক্রে ঠেকিয়া তাহা গুঁড়া হইয়া গেল।
এমনি করিয়া যেই গনেশ আবার বিষ্ণুর সঙ্গে যুদ্ধে ব্যস্ত হইয়াছেন, অমনি শিব পিছন হইতে আসিয়া ত্রিশূল দিয়া তাঁহার মাথা কাটিয়া ফেলিলেন।
হায় ! এই নিদারুণ শোক পার্বতী কিরূপে সহ্য করিবেন? তিনি রাগে আর দুঃখে অস্থির হইয়া এক হাজারটা এমন ভয়ংকর শক্তি তৈরি করিলেন যে, তাহারা দেখিতে দেখিতে সকল সৃষ্টি নাশ করিবার জোগাড় করিল। শিবের কোমর ভাঙ্গিয়া দিল, অন্য দেবতাদিগকে মারিয়া ফেলিতে লাগিল! সে যে কী ভীষণ কাণ্ড, তাহার আর বলিবার নয়।
তখন শুধু আর হাতজোড় ভিন্ন উপায় কি! কিন্তু পার্বতীর কাছে আসিতে কাহারও ভরসা হয় না, তাই দূরে থাকিয়াই দেবতাগণ প্রাণপণে সে কাজ করিতে লাগিলেন। অনেক কান্নাকাটির পর শেষে পার্বতী তাহাদিগকে বলিলেন, “আচ্ছা, গণেশকে যদি বাঁচাইয়া দাও, আর সকল দেবতার আগে তাহার পূজা হয়, তবে আমি তোমাদিগকে ক্ষমা করিব।”
এ কথা শুনিয়া শিব সকলকে বলিলেন, “শীঘ্র তাই কর, নহিলে আর রক্ষা নাই।” অমনি সকলে গণেশকে বাঁচাইবার জন্য ব্যস্ত হইলেন। কিন্তু ইহার মধ্যে ভারি মুশকিল উপস্থিত – গণেশের মাথাটি কোথাও খুঁজিয়া পাওয়া গেল না। তাহাতে শিব বলিলেন, “তোমরা গণেশের শরীর ধুইয়া তাহার পূজা কর, আর কয়েকজন ছুটিয়া উত্তর দিকে যাও। সে দিকে গিয়া প্রথমে যাহাকে দেখিতে পাইবে, তাহারই মাথাটা কাটিয়া আনিয়া গণেশের দেহের সঙ্গে জুড়িয়া দাও।”
তৎক্ষণাৎ উত্তর দিকে সকলে ছুটিল, আর খানিক দূর গিয়াই একটা এক-দাঁতওয়ালা সাদা হাতি দেখিতে পাইল। হাতি হউক, আর যাহাই হউক, উহারই মাথা কাটিয়া নিয়া গণেশের দেহে জুড়িতে হইবে, কাজেই আর কি করা যায়? সেই হাতির মাথা আনিয়া গণেশের দেহে জুড়িয়া মন্ত্র পড়িতেই গণেশ উঠিয়া বসিলেন। তখন পার্বতীরও রাগ দূর হইল, দেবতাদেরও বিপদ কাটিল। সেই অবধি গণেশের হাতির মাথা, আর সেই অবধিই সকল দেবতার আগে গণেশের পূজা হয়।
(সংকলিত)