
- রেমুনা ক্ষীর চোরা গোপীনাথ *
হাতে দু দিন সময় আছে, ছুটির আমেজ! কাছে পিঠে কোথায় যাবেন? এক ঘেয়েমি দীঘা আর ভাল লাগে না। নিন দু-তিনদিনের জন্য ব্যাগ গুছিয়ে নিন, সকাল ৬টায় হাওড়া চলে আসুন। নিউ কমপ্লেক্স এ। চাপুন ধৌলি এক্সপ্রেস এ।গন্তব্য বালেশ্বর বা BALASORE. সকাল ৯টা ১৫ তে পৌঁছে যাবেন বালেশ্বর। যাচ্ছি কোথায়?? চাদিপুর? আরে না ,না। যাব এক তপোবনের দেশে। সব ছেড়ে আপন মনের মাধুরী মিশায়ে সেই সর্বহরনকারীকে দর্শন করতে। তিনি যে চোর, প্রসিদ্ধ চৌরম। ব্রজ গোপিনীদের হৃদয় চুরি করেছেন, আবার এই উৎকল দেশে এসে ক্ষীর চুরি করেছেন। তাই তো এখানে তিনি ‘ক্ষীরচোরা” নামে খ্যাত।বালেশ্বর শহর থেকে মাত্র ৯ কিমি দূরে পরম ভাগবতক্ষেত্র- রেমুনা। রমন শব্দ থেকে রেমুনা নিষ্পন্ন হয়েছে।অর্থ্যাত এই স্থান অত্যন্ত রমনীয়। স্বয়ং মহাপ্রভু গৌরহরি এই স্থানকে গুপ্ত বৃন্দাবন বলে অভিহিত করেছেন। এখানেই বিরাজিত ভগবান গোপীনাথ, যিনি আবার এখানে ক্ষীরচোরা গোপীনাথ নামে আদরনীয়। যাচ্ছি সেখানেই, সেই সুন্দরের সুন্দরকাননে।
বালেশ্বর স্টেশন থেকে বেড়িয়ে দু পা হেটে সোজা চলে আসুন মেন রোডের পাঁচ রাস্তার মোড়ে। পেয়ে যাবেন রেমুনা যাবার টাউন বাস বা অটো। মিনিট ২০ র মধ্যেই পৌঁছে যাবেন রেমুনা মন্দিরের সামনে।আসেপাসে বেশ কিছু হোটেল আছে, আর আছে মন্দিরের নিজস্ব গেষ্ট হাউস। জায়গা পেয়ে যাবেন।বেশীরভাগ লোকই বালেশ্বরে হোটেলে থেকে এখানে ঘুরে চলে যায়। তবে আমি বলবো, এখানেই থাকুন।এখনোও শহুরে আভিজাত্য এস্থানকে গ্রাস করতে পারেনি। দুদিনের জন্য সুইচ অফ করেদিন আপনার মুঠিফোন টাকে। তারপর প্রানভরে উপভোগ করুন সেই আনন্দময়ের সাহচর্য্য।
বহুকাল আগের কথা। ১৪৪৫-১৪৬৫ র মধ্যের ঘটনা। পরম ভাগবত,মহাসাধক ‘মাধবেন্দ্রপুরী’ তখন মধুময় বৃন্দাবনের গিরিগোবরধনে শ্রীনাথজীর সেবায় মগ্ন। এক রাত্রে মাধবেন্দ্র স্বপ্ন দেখলেন, শ্রীনাথজী তাকে বলছেন- হে মাধবেন্দ্র, তোমার সেবা পূজায় আমি বড় তৃপ্ত, কিন্তু আমার অঙ্গের তীব্র জ্বলন কিছুতেই শান্ত হয়নি,অসম্ভব যন্ত্রনা আমি অনুভব করছি। তুমি নীলাচল যাও। সেখান থেকে চন্দন ঘসে নিয়ে এসে আমার সর্বাঙ্গে লেপন করো। আমার অঙ্গের জ্বালা তবেই শান্ত হবে, তুমি কালই যাত্রা করো।নিদ্রাভঙ্গে মাধবেন্দ্র প্রভু শ্রিনাথজী কে প্রনাম করলেন। যাত্রা করলেন নীলাচলের পথে।দীর্ঘ পথ পাড় করে এলেন উৎকল দেশে। যাবার পথে এই পঞ্ছতীর্থ রেমুনার গোপীনাথ দর্শনে এলেন।গোপীনাথ দর্শন করে প্রেমাবেশে নৃত্য কীর্ত্তন করে মাধবেন্দ্র মন্দিরের জগমোহনে বসে আছেন। সন্ধ্যা আরতি হোল, প্রেমভাবে তা দর্শন করলেন তিনি। সেবকদের কাছে জানতে চাইলেন আরতির পর কি কি ভোগ লাগে শ্রীজীউ এর কাছে? সেবকরা জানালেন, রাত্রে এখানে গোপীনাথের কাছে অমৃততোপম ক্ষীর ভোগ লাগে, নাম-অমৃতকেলি। ১২টি মাটির পাত্রে পূর্ণ ক্ষীর ভোগ শ্রীগোপীনাথের অত্যন্ত প্রিয়। অমন স্বাদিষ্ট ক্ষীর পৃথিবীতে আর কোথাও পাওয়া যাবে না। শ্রীপাদ মাধবেন্দ্র অজাচিত বৈষ্ণব।সামান্য লালসা উদ্রেগ হইল মনে। অআচিত ক্ষীর প্রসাদ যদি স্বল্প পাইতাম,তো স্বাদ অনুমানী তেমন ভোগ আমার গোপালে লাগাইতাম। ব্যাস, মূহুর্তে সংযত হলেন পুরীপাদ। একি করলেন তিনি! সাধন হৃদয়ে একি অবাঞ্চচিত বাসনার সঞ্চার হইল? হাত জোর করে মাধবেন্দ্র গোপীনাথের সম্মুখে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। তারপরমন্দির থেকে বেড়িয়ে গিয়ে অনতিদূরে হাটের মধ্যে বসে হরিনাম করতে করতে রাত্রি যাপন করতে লাগলেন। এদিকে অন্তর্যামী ভগবান গোপীনাথ তাঁর পরম ভক্তের হৃদয়ের ভাব অবগত হইলেন। রাত্রে মন্দিরে পুজারী ১২টি মাটির কলসে ক্ষীর সাজিয়ে চোখ বন্ধ করে ধ্যানমগ্ন হয়ে গোপীনাথকে নিবেদন করছেন। হঠাত ধ্যানের মধ্যেই শুনলেন ত্রিভঙ্গমুরারির স্পষ্ট কণ্ঠস্বর। ‘ উঠো পূজারী, চন্ডীহাটে আমার পরম ভক্ত মাধবেন্দ্রপুরী জেগে আছে। তোমার নিবেদিত ১২টি ক্ষীর ভান্ড থেকে একটি চুরি করে আমি আমার ধড়ার আঁচলে লুকিয়ে রেখেছি। তুমি ঐ ক্ষীর ভান্ড এখনি চন্ডিহাটে গিয়ে মাধবেন্দ্রকে দিয়ে এস। স্তম্ভিত ভাঙতেই চোখ খুললেন পুজারী। কি আশ্চর্য।১২টি কলসে ক্ষীর সাজিয়ে ভোগ দিয়েছিলেন তিনি, অথচ চোখ খুলে দেখছেন সামনে ১১টি কলস আছে, ১টি কম।মনে পড়েগেল তাঁর আদেশের কথা। উঠে দাড়ালেন।এগিয়ে গিয়ে গোপীনাথের পরিধানের বস্ত্রাঞ্চলের আঁচলে হাত ভ’রে পেলেন সেই চুরি করে রাখা ক্ষীরভান্ডটি।সেটি নিয়ে রাত্রেই ছুটে গেলেন হাটে। খুঁজে বার করলেন মাধবেন্দ্রকে, জানালেন প্রভুর আদেশের কথা। মাধবেন্দ্রর দুই নয়ন ভেসে গেল জলে। সেই ক্ষীর ভাণ্ডকে প্রদক্ষিণ করে প্রনাম জানালেন, তারপর গ্রহন করলেন সেই অমৃতকেলি।পাছে একথা প্রচার হয়ে যায়, তখন তো লোকজন সব ছুটে আসবেন মাধবেন্দ্রর কাছে। প্রতিষ্ঠা সাধন জীবনের বিড়ম্বনা। তাই সেই রাতেই তিনি রেমুনা ছেড়ে যাত্রা করলেন শ্রীক্ষেত্রের দিকে।সেদিন থেকে রেমুনার গোপীনাথ হলেন ক্ষীরচোরা গোপীনাথ।এদিকে মাধবেন্দ্র হাজির হলেন নীলাচলে। জগন্নাথ মহাপ্রভূকে দর্শন করে প্রেমাবেশে নৃত্য করলেন। শ্রীপাদ পুরীর আগমন বার্তা চতুর্দিকে ছড়িয়ে গেল। উৎকল গজপতি মাধবেন্দ্রর আগমনের কারন জানতে পেরে চন্দন কাঠের সুব্যবস্থা করে দিলেন।সাথে কয়েকজন বাহকও দিলেন।বৃন্দাবন ফেরার পথে পুনরায় শ্রীপাদ পুরী এলেন রেমুনায়। সেখানে সেবকগন তাকে যথার্থ সম্মান দিলেন।সেই রাত্রে মাধবেন্দ্র পুরী আবার স্বপ্ন দেখলেন। তাঁর আরাধ্য শ্রীনাথজী স্বপ্নে আদেশ দিলেন – মাধবেন্দ্র, তোমায় আর কষ্ট করে গোবর্ধনে যেতে হবে না। আমি আর গোপীনাথ এক, অভিন্ন।গোপীনাথের শ্রীঅঙ্গে তুমি চন্দন লেপন করো,তাহলেই আমার অঙ্গের জ্বালা জুড়াবে।সকালে উঠে শ্রীপাদ পুরী গোপীনাথের সেবকদের সেকথা জানালেন। গ্রীষ্মকাল, গোপীনাথ চন্দন পড়বেন জেনে সেবকগন পরমানন্দে নীলাচল থেকে আনা মাধবেন্দ্রর সেই চন্দন কাঠ ঘষতে লাগলেন।মাধবেন্দ্র নিজ হাতে সেই চন্দন ক্ষীরচোরা গোপীনাথের অঙ্গে লেপন করলেন। আজ অবধি সেই চন্দন সেবার পরম্পরা জারি আছে। ১লা বৈশাখ থেকে ১২ঈ জৈষ্ঠ্য অবধি এই সেবা গোপীনাথ পান।
এতো গেল গৌরচন্দ্রিকা।ঘুরে দেখুন মন্দির। মন্দিরের গর্ভগৃহে রত্নসিঙ্ঘাসনে তিনটি কলেবর। মাঝখানে আছেন ক্ষীরচোরা গোপীনাথ, গোপীনাথের বামে গোবিন্দ আর ডাইনে মদনমোহন বিরাজিত।এছাড়া দোল গোবিন্দ, রাধারানী,বটকৃষ্ণ, লাড্ডু গোপাল, মহাপ্রভূ গৌরসুন্দর, নরসিঙ্ঘদেব, হাটোয়া গোপাল, রাসবিহারী, ও আরো অনেক শালগ্রাম পূজিত হয়। মন্দিরে ভোরে মঙ্গলারতি থেকে রাত্রে বিশ্রাম অবধি ৮ বার আরতি হয়।পৃথিবী বিখ্যাত ক্ষীর ভোগ ‘অমৃতকেলি’ সন্ধ্যাবেলায় লাগে। গোপীনাথ কে সপ্তাহে ৭দিনে সাত রঙের পোষাক পড়ানো হয়। দুপুরে পাওয়া যায় অন্নভোগ এর মহাপ্রসাদ। সকালে মন্দিরের অফিস থেকে কুপন কাটতে হবে। খোলা আকাশের নীচে কামরাঙ্গা গাছের ছায়াতে বসে প্রসাদ পাবার অনুভূতিই আলাদা। মন্দিরের ভিতরে নাটমন্দিরকে কেন্দ্র করে দেওয়ালে খোদিত আছে কৃষ্ণ লীলার নানা ভার্স্কয্য। ডেকে মন ভোরে যাবে। বেড়িয়ে আসুন মন্দির থেকে । বাম দিকে পুকুর পাড়ে রয়েছে এক আর্শ্চয্য অশ্বত্থ গাছ, যার পাতা গুলি সব ঠোঙার মত মোড়া। ডেকে বেশ ভাল লাগবে। এবার রাস্তা ধরে আসুন উত্তরপশ্চিমে। দেখে নিন রামচন্ডী মাতার মন্দির। পাশেই রয়েছে মাধবেন্দ্রপুরীর মঠ ও সমাধি। দেখে সোজা হাঁটুন। দেখেনিন সপ্তশরা নদী। রামচন্দ্রের সাতবার শর নিক্ষেপে এর সৃষ্টি। এবার আসুন গার্গেশ্বর মহাদেবের মন্দিরে। এই শিব লিঙ্গ পাতাল থেকে স্বয়ং বেড় হয়েছেন। গরভমন্দিরের নীচে প্রায় ৭ ফুট নেমে একটি গোল গহ্বর। তারও মধ্যে কনুই অবধি হাত ভরে স্পর্শ করতে হয় মহাদেব কে।মন্দিরটি অসুররাজ বানাসুরের দ্বারা নির্মিত হয়েছে বলে কথিত আছে। এবার এখান থেকে ফিরে আসুন মন্দিরের কাছে। অটো ধরে যান ২কিমি উত্তরে লালপাটনার কোটপুকুরে। দেখেনিন অষ্টভূজা দূর্গা ও জগন্নাথদেবের একত্র মন্দিরটি। ফিরে আসুন আবার নিজের ডেরাতে। বিকালে সময় করে চলে যান বাস বা অটো ধরে বালেশ্বর টাউনে।সব্জীমন্ডীর পাসে দেখে নিন বাঁটিয়া জগন্নাথ দেবের মন্দির। এই মন্দিরে পুরীর মতোই সারাদিন ধরে বহু রকম প্রসাদ পাওয়া যায়। ইচ্ছা হলেই পেতে পারেন সেই প্রসাদ এর স্বাদ। বালেশ্বরের মোতীগঞ্জ বাজার থেকে ফেরার আগে কিনতে পারেন সম্বলপুরী কাপড়। আর এখানকার বিখ্যাত মিষ্টি- ছানাপোরো ও বেসনের মাইসোরপাক সন্দেশ। ফেরার আগে গোপীনাথের ক্ষীর প্রসাদ অমৃতকেলি আনতে যেন ভুলবেন না।। হাতে সময় থাকলে একদিন ঘুরে নিতে পারেন ৩৫ কিমি দুরের পঞ্চলিঙ্গেশ্বর। প্রাকৃতিক শোভা চোখ ভরিয়ে দেবে। ঘুরে এসে জানান কেমন লাগলো।
ট্রেন ঃ হাওড়া থেকে যে কোনো দক্ষিনভারতগামী ট্রেন। তবে ভাল হবে সকালে ধৌলি বা ফলকনামা এক্সপ্রেস এ গেলে। নামুন বালেশ্বর এ। বাস বা অটোতে যান রেমুনা। মন্দিরের কাছেই কিছু হোটেল আছে। এছাড়া মন্দিরের গেষ্ট হাউসে থাকতে পারেন। আগে থেকে ফোনে বলে রাখা দরকার। মন্দিরের অফিসের ফোন নং-০৬৭৮২ ২২৪২৪৫ / ০৯৭৭৭১৬০৫৫৯(ট্রাষ্টি ম্যানেজার)। খুব গরমের সময় বাদ দিয়ে যে কোন সময় যান।