সাকার ও নিরাকারের অভেদ

ব্রহ্ম ও শক্তি বা শিব ও কালী, এই দুয়ের ভেদ ও অভেদ তত্ত্বের ব্যাপারে শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছেন, “ব্রহ্ম আর শক্তি অভেদ, এককে মানলেই আরেকটিকে মানতে হয়।” উদাহরণ হিসেবে অগ্নি আর তার দহনশক্তি। অগ্নি আছে মানলেই তার দহনশক্তি মানতেই হবে। দহনশক্তি ছাড়া অগ্নিকে ভাবা যায় না আবার অগ্নিকে বাদ দিয়ে দহনশক্তি কল্পনা করা যায় না। সূর্যকে বাদ দিয়ে সূর্যের রশ্মির অস্তিত্ব নেই আবার সূর্যের রশ্মিকে ছেড়ে সূর্যকে ভাবা যায় না। তাই ব্রহ্মকে ছেড়ে শক্তিকে বা শক্তিকে ছেড়ে ব্রহ্মকে স্বীকার করা যায় না। নিত্যকে (পরম বা Absolute Truth) ছেড়ে লীলা (আপেক্ষিক বা Relative Truth) এবং লীলাকে ছেড়ে নিত্য ভাবা যায় না। শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ কথামৃত তে এক জায়গায় বলা হয়েছে, ‘আদ্যাশক্তি লীলাময়ী, তিনিই সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয় করছেন, তাঁরই নাম কালী, কালীই ব্রহ্ম, ব্রহ্মই কালী। একই বস্তু যখন তিনি নিস্ক্রিয়, সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয় কোনো কাজ ই করেন না এই কথা যখন ভাবি তখন তাঁকে ব্রহ্ম বা শিব বলে কই। আবার যখন তিনি এইসব কার্য করেন তখন তাঁকে কালী বলি, শক্তি বলি। একই ব্যক্তি- নাম রূপভেদ।’ ব্রহ্মের এই মাতৃরূপ বা শক্তিরূপ বিভিন্ন নাম ও রূপে আরাধিতা ও পূজিতা হন। মহাভারতে আছে যুদ্ধে বিজয় লাভের জন্য শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে দুর্গা-স্তব করার উপদেশ দিয়ে বলেছেন, “পরাজয়ায় শত্রুণাং দুর্গাস্তোত্রম উদীরয়।” শ্রীকৃষ্ণ এর আদেশে অর্জুন স্তব করছেন, “ভদ্রকালী নমস্তুভ্যং মহাকালী নমহস্তু তে। চন্ডি চন্ডে নমস্তুভ্যং তারিণি বরবর্ণিনি।” (মহাভারত ভীষ্মপর্ব) অতএব আমরা দেখতে পাচ্ছি যে নিরাকার অব্যক্ত নির্গুণ ব্রহ্মের এই ব্যক্ত ও সগুণ প্রকাশ হোলো মাতৃশক্তি যিনি কখনও মহাকালী, কখনও ভদ্রকালী, কখনও দুর্গা আবার কখনও চন্ডি। এইক্ষেত্রে শিব ও বিষ্ণুর বিষয়েও কিছু কথা বলা প্রয়োজন। স্কন্দোপনিষদে্ স্বয়ং ভগবান স্কন্দ বলছেন যে জীবই (কোনো জীবিত সত্ত্বা) শিব। ভুসি ছাড়ানোর আগে যা ধান, ভুসি ছাড়ানোর পরই সেই একই শস্যদানাটি হয়ে যায় চাল। সেই রকম যখন কর্মের বন্ধনে আবদ্ধ তখন যে জীব এবং কর্মের বন্ধন থেকে মুক্ত তখনই সে শিব। এরপর স্কন্দ সেই শিবকে প্রনাম করছেন যিনি বিষ্ণুর একটি রূপভেদ এবং যে বিষ্ণু শিবেরই একটি রূপভেদ। এই উপনিষদেই বলা হয়েছে বিষ্ণু শিবের হৃদয়ে এবং শিব বিষ্ণুর হৃদয়ে বাস করেন। এনারা এক এবং অদ্বিতীয়। সুতরাং আমরা এটুকু বুঝতে পারলাম যে আমরা যাদেরকে সাকার রূপে শিব, বিষ্ণু, কালী, দুর্গা বা নিরাকার রূপে ব্রহ্ম, শক্তি, মায়া বলে থাকি সেগুলো সব ই এক। কোনো পার্থক্য নেই। এই চরম সত্য উপলব্ধি করে জীবনে ঈশ্বর সাধনা করলেই আমরা সাফল্য অর্জন করতে পারবো।।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *